মোঃমিজানুর রহমান,বাহার ভালুকা প্রতিনিধি: কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের প্রতীক বাংলাদেশের জাতীয় ফুল শাপলা।

এক সময় ভালোবাসা ও মনমুগ্ধকর ঘ্রাণ ছিল যেন শাপলা ফুলের মাঝে। তেমনি ছিল মানুষের মুখে মুখে এই জাতীয় ফুল শাপলার অপরূপ সৌন্দয্যের কথা। ভালোবাসার প্রেয়সীর চুলের খোঁপায় গেঁথে থাকত আমাদের জাতীয় ফুল শাপলা। কিন্তু বিলুপ্তির পথে সেই গ্রামাঞ্চলের পুকুর-দীঘি বা বিভিন্ন জলাশয়ে ফুটে থাকা প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের প্রতীক জাতীয় ফুল শাপলা। এক সময় প্রকৃতির মাঝে ভোরের স্নিগ্ধতা, শীতের ঘন কুয়াশা আর পাখিদের কিচিরমিচির ডাকে শীতের কুয়াশা কাটতে না কাটতেই সূর্যের আলোকরশ্মিতে শাপলা ফুলের হাসি মানুষকে মনমুগ্ধ করে তুলত। শাপলা বাংলাদেশের একটি অতি পরিচিত জলজ উদ্ভিদ। শাপলা পৃথিবীর সবদেশেই কম বেশি হয়ে থাকে, তবে এর উৎপত্তি মিশরে হয়েছে বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন । মিশরের নীল নদের নানা রংয়ের শাপলা আজও বিশ্বখ্যাত। শাপলা পাতা গোলাকৃতি ঘন সবুজ রংয়ের, কিনারায় দাঁতের মত প্রতিটি পাতা একটি দন্ডের উপর পানিতে ভাসমান থাকে। যাকে বলা হয় পত্রদন্ড, যে দন্ডের উপরে সকালে ফুল ফোটে আর সন্ধ্যায় বন্ধ হয়ে যায় তাকেই বলা হয় শাপলা।

শাপলার যে অংশটি মাটির নিচে থাকে তার নাম শালুক। বাংলাদেশের বিল-ঝিল, হাওড়-বাওড় এমনকি জলাশয়সহ বিভিন্ন ডোবাতেও প্রাকৃতিক ভাবে শাপলার জন্ম হয়। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের জাতীয় ফুল শাপলা তেমন আর চোখে পড়ে না। এক সময় গ্রামীণ জনপদের পুকুর- দীঘি, ডোবা, বিলঝিলের শাপলা ফুলের সৌন্দর্য মানুষকে মনমুগ্ধ করত। প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে এ ফুল ছিল সাহিত্যের ছন্দমিলানোর উপকরণ। ফুলের সৌন্দর্যে পুকুর-দীঘি দেখতে আকর্ষণীয় ও মনোমুগ্ধকর ছিল। শাপলা ফুল দুই প্রকারের, সাদা ও রক্ত শাপলা। রক্ত শাপলা সবচেয়ে আকর্ষণীয়। এ ফুল প্রকৃতির শোভাবর্ধণের উপকরণও বটে। তাছাড়া ফুলের ডাঁটাগুলো সুস্বাদু তরকারি হিসেবে হয়ে থাকে। ডাল দিয়ে রান্না করলে শাপলা ফুলের ডাঁটা খেতে খুব সুস্বাদু। চিকিৎসা বিজ্ঞানে শাপলা ফুল ও ডাঁটা এক প্রকার ঔষধি গাছ হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। মস্তিস্ক ও শরীর ঠান্ড রাখার জন্য শাপলার ডাঁটা লবণ দিয়ে খেলে খুব উপকার পাওয়া যায় বলে চিকিৎসকরা মনে করেন। এ ফুল ও ডাঁটা কবিরাজি ওষুধের অন্যতম উপকরণ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। প্রচীনকালের এক সময় বিত্তশালী ও জমিদার পরিবারগুলো নিজেদের ব্যবহার ও এলাকার মানুষের জলাচারের জন্য পুকুর- দীঘি খনন করত। বিত্তশালী জমিদার পরিবারের মহিলাদের ব্যবহারের জন্য বাড়ির ভেতরের আঙিনায় পুকুর-দীঘি খননের রেওয়াজ ছিল। পুকুরের শোভাবর্ধণের জন্য শাপলা ফুলের গাছ লাগানোর কথাও জনশ্রুতি রয়েছে। আবার যে পুকুরে শাপলা ফুলের আবাদ হয় সেখানে বিভিন্ন ধরনের দেব-দেবী ও জ্বীনপরীর আশ্রায় থাকার কথাও লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের খাদ্য তালিকায় প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করতে পুকুর-দীঘিগুলো কালক্রমে আবাদ হতে থাকে। এসব পুকুর-দীঘি মাছ চাষের জন্য আবাদ ও সেচ দিতে গিয়ে শাপলা ফুল গাছের মূল উপড়ে ফেলা হচ্ছে। তাছাড়া অংশীদারিত্বের বিবাদের কারণে অনেক পুকুর-দীঘি, বিলঝিল, ময়লা, আবর্জনায় ভরে গিয়ে ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। পরিষ্কার পুকুর-দীঘিতে সাধারণত শাপলা ফুলের আবাদ হয়ে থাকে। আবর্জনায় ভরা পুকুর-দীঘিতে এ জাতীয় ফুলের আবাদ হয় না। আবার অনেক জায়গায় বসতি স্থাপন করতে গিয়ে প্রতিযোগিতা মূলক ভাবে গৃহস্থ’ বাড়ির ঐতিহ্য পুকুর-দীঘি ভরাট করে ফেলা হচ্ছে। এতে শাপলা ফুলের আবাদও কমতে শুরু করেছে। যাদের পুকুর-দীঘিতে শাপলা ফুল ফোঁটে তারা নিজেদেরকে সৌভাগ্যবান হিসেবে আখ্যায়িত করেন। মাছ চাষ করতে গিয়ে প্রতি বছর পুকুর-দীঘি ও জলাশয়ের পানি সেচে শুকিয়ে ফেলা হচ্ছে। এতে সূর্যের তাপে পুকুর-দীঘি ও জলাশয়ের তলদেশের মাটি শুকিয়ে শাপলা ফুলের বীজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে এ ফুল এখন আর গ্রামাঞ্চলে সচারাচার দেখা যায় না।

বাংলাদেশের সংবিধানে শাপলাকে জাতীয় ফুল হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠনের পাঠ্যবইয়ে শাপলা ফুলের ব্যাপারে নানাভাবে বর্ণনা দেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবইয়ে শাপলা ফুল নিয়ে পড়াশোনা করেন, এমনকি পরীক্ষাও দিয়ে থাকেন। তারা বইয়ের ছবিতে শাপলা ফুলের আকার আকৃতি দেখে থাকে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এ ফুল তারা এখন তেমন দেখতে পায় না। জাতীয় এ ফুলকে শিক্ষার্থীদের প্রদর্শন করে দেখানোর জন্য গ্রামাঞ্চলের কিছু কিছু পুকুর-দীঘিসহ বিভিন্ন জলাশয়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এ ফুলের চাষাবাদ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন অনেকেই। বিশেষ করে সরকারি খাস পুকুর-দীঘি কিংবা পতিত জলাশয়ে মনোমুগ্ধকর এ ফুলের চাষাবাদ করা এখন সময়ের দাবি।